গত দেড় দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের অর্ধেকের বেশি বেসরকারি খাতের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এরপর দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো কোম্পানিকে লাভবান করতে বেসরকারি খাতে জ্বালানি তেল বিক্রির নীতিমালা করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে সরাসরি বাজারে জ্বালানি তেল বিক্রির অনুমতি পায় বসুন্ধরা গ্রুপ।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এর আগে গত ১০ জুন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে (বিপিসি) চিঠি দেয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। বসুন্ধরা অয়েল অ্যান্ড গ্যাস কোম্পানিকে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় অপরিশোধিত তেল আমদানি, মজুত, পরিবহন ও বিক্রির অনুমতি দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) একমাত্র রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি যা বর্তমানে দেশে জ্বালানি তেল আমদানি করে এবং সরবরাহ করে। বিশেষজ্ঞ ও ভোক্তা অধিকার কর্মীরা বলছেন, জ্বালানি তেলের ব্যবসা বেসরকারি খাতে দিলে জনগণকে তা বেশি দামে কিনতে হবে। বিদ্যুৎ খাতেও তাই হয়েছে। জ্বালানি তেল একটি 'কৌশলগত' পণ্য। এর ব্যবসা সম্পূর্ণভাবে পাবলিক সেক্টরে হওয়া উচিত।
বেসরকারি খাতের অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ। একচেটিয়া মুনাফার প্রবণতা মূল্য নিয়ন্ত্রিত নয়। জ্বালানি খাতের বাজার ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যাবে না, সরকারের হাতে রাখতে হবে।
এম শামসুল আলম, জ্বালানি উপদেষ্টা, ক্যাব
জ্বালানি অধিদফতরের বাজারে জ্বালানি তেল বিক্রির অনুমতির কথা জানিয়ে গত ১৮ জুলাই বসুন্ধরাকে চিঠি দেয় বিপিসি। চুক্তি স্বাক্ষরের আগে নন-জুডিশিয়াল স্টাম্পের একটি লিখিত অঙ্গীকার এবং ৩৮৮টি ফিলিং স্টেশন নিয়ে নিজস্ব বিপণন ব্যবস্থা তৈরিসহ একটি বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা জমা দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কর্মপরিকল্পনা জমা দেয়নি বসুন্ধরা।
বিপিসির দুই দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলো</em>কে বলেন, বেসরকারি খাতে জ্বালানি তেল বিক্রির অনুমতি দিতে রাজি নয় বিপিসি। তাই শুরু থেকেই তারা এ বিষয়ে নেতিবাচক সুপারিশ করেছে জ্বালানি বিভাগের কাছে। সাত বছরে পর্যায়ক্রমে তা বন্ধ করা হয়েছে। এরপর জ্বালানি বিভাগের অনুমোদনের এক মাসেরও বেশি সময় পর বসুন্ধরায় চিঠি পাঠানো হয়। এখন সরকারের নতুন সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় বিপিসি।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) একমাত্র রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি যা বর্তমানে দেশে জ্বালানি তেল আমদানি করে এবং সরবরাহ করে। বিশেষজ্ঞ ও ভোক্তা অধিকার কর্মীরা বলছেন, জ্বালানি তেলের ব্যবসা বেসরকারি খাতে দিলে জনগণকে তা বেশি দামে কিনতে হবে। বিদ্যুৎ খাতেও তাই হয়েছে।
জ্বালানি বিভাগ অনুমোদনের চিঠিতে ৩৭টি শর্ত সংযুক্ত করেছে। সরকার এসব শর্ত লঙ্ঘন করলে কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই অনুমোদন বাতিল করা হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শর্তগুলির মধ্যে রয়েছে তেল ব্যবস্থাপনা এবং বিক্রয় এবং সুরক্ষা বন্ডের বিধানের জন্য বিপিসির সাথে একটি চুক্তি, উৎপাদিত জ্বালানী তেলের 60 শতাংশ প্রথম তিন বছরের জন্য বিপিসির কাছে বিক্রি করা হবে এবং অবশিষ্ট 40 শতাংশ নিজস্ব বিপণন ব্যবস্থার মাধ্যমে এবং 50 শতাংশ আগামী দুই বছরের জন্য বিপিসির বাইরে শতকরা। শতাংশ তেল বিক্রির সুযোগ। তেলের দাম নির্ধারণ করবে বিপিসি। বিপিসি থেকে চাহিদা না থাকলে কোম্পানির আপত্তি ছাড়াই জ্বালানি তেল বাজারে বা বিদেশে রপ্তানি করা যেতে পারে।
শর্তে আরও বলা হয়েছে, বসুন্ধরা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় তেল বিক্রির জন্য তিন বছরে সারাদেশে ৩৮৮টি ফিলিং স্টেশন বা পরিবেশক নিতে পারবে। যেসব সিএনজি ও এলপিজি স্টেশনে তেল বিক্রির অনুমতি নেই সেগুলোও বসুন্ধরার পরিবেশক হতে পারে। সরকারি কোম্পানি পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার পরিবেশকরা চুক্তি বাতিল করে বসুন্ধরার পরিবেশক হতে পারেন।
বিপিসির চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান গত রোববার প্রথম আলো</em>কে বলেন, বসুন্ধরা এখন পর্যন্ত কোনো কর্মপরিকল্পনা উপস্থাপন করেনি। তাই এ বিষয়ে আর কোনো অগ্রগতি নেই। তবে বেসরকারি খাতে জ্বালানি বিক্রির নীতি বাতিল করা হয়নি। এ বিষয়ে নতুন কোনো নির্দেশনা দেয়নি জ্বালানি বিভাগ। তিনি বলেন, বসুন্ধরা অ্যাকশন প্ল্যান উপস্থাপন করলে বিপিসি জ্বালানি বিভাগের নির্দেশনা মেনে চলবে।
বসুন্ধরার জন্য নীতিমালা প্রণয়ন
আবেদনকারীর যোগ্যতায় বলা হয়েছে, বেসরকারি খাতে জ্বালানি তেল বিক্রির অনুমতি পেতে হলে বার্ষিক ১৫ লাখ টন জ্বালানি তেল উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন একটি শোধনাগার নির্মাণ করতে হবে। এরই মধ্যে দুই লাখ টন জ্বালানি তেল সংরক্ষণ ক্ষমতা তৈরি করতে হবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, বসুন্ধরাকে সক্ষম করার জন্য একটি 'বেসরকারি আমদানিকৃত অপরিশোধিত তেল স্টোরেজ, প্রক্রিয়াকরণ, পরিবহন এবং বিপণন নীতি-2023' প্রণয়ন করা হয়েছে। বসুন্ধরা ছাড়া আর কেউ আবেদন জমা দেননি।
ঢাকার কেরানীগঞ্জে বসুন্ধরা শোধনাগারে 2019 সালে বিটুমিন উৎপাদন শুরু হয়। এই বিটুমেনগুলি রাস্তা এবং হাইওয়ে পাকা করতে ব্যবহৃত হয়। বিটুমিন পরিশোধন ছাড়াও কিছু ডিজেল, জ্বালানি তেল এবং ন্যাফথাও সেখানে উৎপাদিত হয়। এছাড়া চট্টগ্রামে আরেকটি শোধনাগার নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল বসুন্ধরার।
বসুন্ধরা এখন পর্যন্ত কর্মপরিকল্পনা উপস্থাপন করেনি, তাই এ বিষয়ে আর কোনো অগ্রগতি নেই। তবে বেসরকারি খাতে জ্বালানি বিক্রির নীতি বাতিল করা হয়নি। এ বিষয়ে নতুন কোনো নির্দেশনা দেয়নি জ্বালানি বিভাগ। তিনি বলেন, বসুন্ধরা অ্যাকশন প্ল্যান উপস্থাপন করলে বিপিসি জ্বালানি বিভাগের নির্দেশনা মেনে চলবে।
বিপিসির সভাপতি মো. আমিন উল আহসান
বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, বসুন্ধরা 15 জুন, 2016-এ বিটুমিন উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি পায়। তারপর 6 সেপ্টেম্বর, 2017-এ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় জ্বালানি তেল বিক্রির অনুমতি চায়। ওই বছরের অক্টোবরে বিপিসি এ বিষয়ে নেতিবাচক মতামত পাঠায় জ্বালানি বিভাগের কাছে। জ্বালানি বিভাগের অনুরোধে অক্টোবর 2018 সালে একটি উচ্চ-পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটি বসুন্ধরার তেল বিপিসির কাছে বিক্রির সুপারিশ করেছে। বসুন্ধরা 2020 সালের জুলাইয়ে আবার আবেদন করেছে। তারা বিটুমিন সরাসরি ভোক্তাদের কাছে এবং ডিজেল বিপিসির কাছে বিক্রি করার অনুমতি পেয়েছে। আর বিপিসির অনুমতি নিয়ে তারা বাজারে জ্বালানি তেল ও পেট্রল বিক্রি করছে।
সরকারী নথি অনুসারে, বসুন্ধরা 31 মার্চ, 2022-এ প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীকে জ্বালানি বিভাগের অনুমতি না নিয়ে সরাসরি বাজারে তেল বিক্রি করার জন্য অনুরোধ করেছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের জুনে জ্বালানি অধিদপ্তর আবারও বিপিসির মতামত জানতে চায়। বিপিসি মতামত দিয়েছে যে বেসরকারি খাতকে সীমিত ভিত্তিতে আমদানি ও বাণিজ্যের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। এরপর এ বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়নের বিষয়ে বিপিসি ও জ্বালানি বিভাগের মধ্যে চিঠি বিনিময় হয়। গত বছরের ১১ জুন বেসরকারি খাতে জ্বালানি তেল বিক্রি নীতি সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ওই বছরের নভেম্বরে বসুন্ধরা অয়েল আবার জ্বালানি তেল বিক্রির অনুমতি চেয়ে আবেদন করে। গত বছরের জুনে অনুমতি দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বসুন্ধরা গ্রুপের প্রেস অ্যান্ড মিডিয়া উপদেষ্টা মোহাম্মদ আবু তৈয়ব প্রথম আলো</em>কে বলেন, বিষয়টি তিনি অবগত নন। বসুন্ধরার তেল-গ্যাস ব্যবসা দেখভাল করছেন বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহানের সচিব ও বসুন্ধরা গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক মাকসুদুর রহমান।
মাকসুদুর রহমানের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। এমনকি তাকে হোয়াটসঅ্যাপে একটি ছোট বার্তা পাঠিয়েও সাড়া মেলেনি।
সরাসরি বাজারে তেল বিক্রি শুরু করলে বিপিসির সঙ্গে পাল্লা দেবে বসুন্ধরা। বিশেষজ্ঞ ও বিপিসি কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, বাজারে সরাসরি তেল বিক্রির অনুমতি দিলে বেসরকারি খাত প্রাথমিকভাবে কম দামে বিক্রি করবে, যা সরকারি প্রতিষ্ঠানকে সংকটে ফেলবে।
জ্বালানি নিরাপত্তা হুমকির ভয়
সরাসরি বাজারে তেল বিক্রি শুরু করলে বিপিসির সঙ্গে পাল্লা দেবে বসুন্ধরা। বিশেষজ্ঞ ও বিপিসি কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, তেলের বাজারে সরাসরি বিক্রির অনুমতি দেওয়া হলে বেসরকারি খাত প্রাথমিকভাবে কম দামে বিক্রি করবে এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানকে সংকটে ফেলবে। একবার তারা তেলের বাজার দখল করে নিলে দাম বাড়িয়ে দেবে। এখন জাতীয় কোম্পানিগুলো জনগণের স্বার্থ বিবেচনা করে দাম নির্ধারণ করে। আর লাভের মুখ দেখছে বেসরকারি খাত।
বিশেষজ্ঞরা এক্ষেত্রে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) উদাহরণ দিয়েছেন। তারা বলছেন, এলপিজি খাত বেসরকারি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে। সরকার দাম নির্ধারণ করলেও কেউ মানে না। ভোক্তাদের ফি দিতে হবে। বিদ্যুৎ খাতকে এখন বিপুল পরিমাণ কেন্দ্রীয় ভাড়া দিতে হচ্ছে। ব্যাপক হারে বেড়েছে বিদ্যুতের দাম।
পেট্রোল পাম্প মালিকরা বলছেন, প্রাথমিকভাবে কম দামে সরবরাহ করে সরকারি কোম্পানির বাজার ধ্বংস করতে পারে বেসরকারি কোম্পানিগুলো। আবার বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে মজুতদাররা দাম বাড়াতে চাপ সৃষ্টি করতে পারে। যেহেতু জ্বালানি তেল সরকারি খাতে, তাই মূল্য নিয়ন্ত্রণ সহজ।
বেসরকারি খাতের অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ। একচেটিয়া মুনাফার প্রবণতা মূল্য নিয়ন্ত্রিত নয়। জ্বালানি খাতের বাজার ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যাবে না, সরকারের হাতে রাখতে হবে। তাই অবিলম্বে বসুন্ধরার অনুমোদন প্রত্যাহার করতে হবে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম
দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদা বছরে প্রায় ৭ মিলিয়ন টন। এর মধ্যে সরকারি কোম্পানি ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড দেশে দেড় লাখ টন পরিশোধন করে। বাকিগুলো পরিশোধিত আকারে আমদানি করা হয়। প্রতি বছর জ্বালানি তেলের চাহিদা বাড়ছে। 2026-27 অর্থবছরে চাহিদা বেড়ে 80 লাখ টন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দেশে অপরিশোধিত তেল আমদানি ও পরিশোধন করা গেলে খরচ কমবে। তাই, 3 মিলিয়ন টন পরিশোধন ক্ষমতা সম্পন্ন একটি প্ল্যান্ট নির্মাণের জন্য ERL-2 নামে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। তবে এক যুগেও এটি সরকারের চূড়ান্ত অনুমোদন পায়নি।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম প্রথম আলো</em>কে বলেন, বেসরকারি খাতের অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ। একচেটিয়া মুনাফার প্রবণতা মূল্য নিয়ন্ত্রিত নয়। জ্বালানি খাতের বাজার ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যাবে না, সরকারের হাতে রাখতে হবে। তাই অবিলম্বে বসুন্ধরার অনুমোদন প্রত্যাহার করতে হবে।
পেট্রোল পাম্প মালিকরা বলছেন, প্রাথমিকভাবে কম দামে সরবরাহ করে সরকারি কোম্পানির বাজার ধ্বংস করতে পারে বেসরকারি কোম্পানিগুলো। আবার বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে মজুতদাররা দাম বাড়াতে চাপ সৃষ্টি করতে পারে। যেহেতু জ্বালানি তেল সরকারি খাতে, তাই মূল্য নিয়ন্ত্রণ সহজ হচ্ছে।