প্রিপেইড মিটার বসানোর আগে বিল আসত এক টাকা থেকে সর্বোচ্চ দেড় হাজার টাকা। এখন আপনাকে প্রতি মাসে কমপক্ষে 3 হাজার টাকা রিচার্জ করতে হবে। তবে ব্যবহার বাড়েনি। এমনকি কয়েক মাস আগেও ২ হাজার টাকা রিচার্জ করা যেত। প্রতারণামূলকভাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেশি টাকা কেটে নেওয়া হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়।
এমন অভিযোগ নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের মিন্টুর। শুধু মিন্টু নন, তার মতো লাখ লাখ গ্রাহক প্রিপেইড মিটারে অতিরিক্ত চার্জ নেওয়ার অভিযোগ করেছেন। এছাড়াও প্রতি 1000 টাকার রিচার্জের জন্য ডিমান্ড চার্জ, মিটার ভাড়া, রিবেট এবং ভ্যাট সহ মোট 200 টাকার বেশি কাটছাঁট করা হয়।
তবে গ্রাহকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যুৎ কর্মকর্তারা বলছেন, চুরি, অপচয় রোধ ও উন্নত সেবা নিশ্চিত করতে গ্রাহকদের বাড়িতে প্রিপেইড বিদ্যুতের মিটার বসানো হচ্ছে। গ্রাহকের অজান্তেই বেশি বিল কেটে নেওয়ার অভিযোগ সরাসরি নাকচ করে দেন তারা।
তবে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, প্রিপেইড সিস্টেমে একটি ফাঁক রয়েছে। আর জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফওজুল কবির খান সময়ের আলোকে বলেন, অভিযোগটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ইতিমধ্যে প্রায় ২৮ লাখ প্রিপেইড মিটার স্থাপন করা হয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে শতভাগ গ্রাহককে প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনার কাজ চলছে। রাজধানীর ঝিগাতলার আব্দুল হাদী (ছদ্মনাম) বেশ কয়েকদিন ধরে লক্ষ্য করেছেন যে তার প্রিপেইড মিটার ২-৪ দিন পর রিচার্জ করতে হবে। বাধ্য হয়ে তিনি ডিপিডিসির ওয়েবসাইট থেকে বিদ্যুৎ খরচের পরিসংখ্যান ডাউনলোড করেন। দেখা যায় যে তিনি সাধারণত দৈনিক 20 থেকে 50 ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন। কিন্তু গত ১ মে একদিনে ৫২২টি ইউনিট ব্যবহার করা হয়েছে, যার বিল হয়েছে রুপি। 4,656। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিপিডিসি কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি।
মিতালী রোডের মো. জিল্লুর রহমান খান সময়ের আলোকে বলেন, আগে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকার বেশি খরচ হলেও বিল আসেনি। এখন প্রিপেইড মিটার বসানোর পর বিল অনেক বেশি। কিন্তু আমার বিদ্যুৎ খরচ আগের তুলনায় কম। তার মতে, প্রিপেইড মিটার আসলে শুভঙ্করের একটি কেলেঙ্কারি।
লক্ষ লক্ষ গ্রাহক প্রিপেইড মিটারের উচ্চ মূল্য নিয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করতে সোশ্যাল মিডিয়ায় এসেছেন। এমএইচ রবিন নামে এক ব্যক্তি ফেসবুকে লিখেছেন, 'স্মার্ট চোর। বিচার করবে কে? বিচার করবে কে? একটি মিটার কিনতে হয় ৫০-৬০ হাজার টাকায়। অফিস থেকে সিস্টেম অনুমোদন পেতে আরও ৮-১০ হাজার টাকা লাগে। তারপর মিটার ভাড়া প্রতি মাসে বিল করা হয়। আমার মিটার, আমাকে আবার দিতে হবে। কি অদ্ভুত!'
অনেকে পোস্টের নিচে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের অভিযোগ, বিল বাড়ানোর পরও গ্রাহকের অজান্তেই বেশি টাকা কেটে নেওয়া হয়। এটা চুরি। অনেকেই দাবি ও মিটার চার্জের বিরোধিতা করবেন। এছাড়া রিচার্জ করতে না পারা, মিটার লক হয়ে যাওয়া, ব্যাটারি ফুরিয়ে যাওয়ার সমস্যায় পড়তে হয়। প্রিপেইড মিটারের পরিবর্তে পুরনো অ্যানালগ মিটার বসানোর দাবিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনও চলছে।
সম্প্রতি নানা অনিয়ম ও হয়রানির কারণে প্রিপেইড বিদ্যুতের মিটার বাতিলসহ ৭ দফা দাবিতে নাটোরে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি নেসকোর নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় ঘেরাও করে শিক্ষার্থীরা। গত সপ্তাহে, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) সিদ্ধিরগঞ্জে গ্রাহকদের প্রিপেইড মিটার বাতিল ও পোস্টপেইড মিটারের সংযোগ, অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিদ্যুতের বিল, মিটার চার্জ এবং অতিরিক্ত চার্জ থেকে নিজেদের বাঁচাতে সাত দিনের আল্টিমেটাম দিয়েছে। এদিকে, গত বছরের জুনে সারাদেশে প্রিপেইড বিদ্যুতের মিটারে ভোগান্তির গ্রাহকদের অভিযোগ তদন্তে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে আদালতকে বিষয়টি তদন্ত করে এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হলেও তা এখনো দেওয়া হয়নি।
তবে বিদ্যুৎ কর্মকর্তারা বলছেন, বিল বেশি কমানোর কোনো সুযোগ নেই। গ্রাহকের বিদ্যুতের পরিমাণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে কেটে নেওয়া হয়। এটি কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত এবং পর্যবেক্ষণ করা হয়। সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিল বেড়েছে। সে জন্য গ্রাহকের খরচ কিছুটা বেড়েছে। গ্রীষ্মকালে ভোক্তারা শীতের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন, যার ফলে খরচ বেশি হয়। এছাড়া প্রতি মাসে একবার গ্রাহকের কাছ থেকে ডিমান্ড চার্জ, মিটার ভাড়া, প্রতি কিলো লোড ভাড়া, ভ্যাট-ট্যাক্স ও সার্ভিস চার্জ কেটে নেওয়া হয়। বাধার কোন সুযোগ নেই। গ্রাহকরা যখন খুশি বিভিন্ন চার্জ এবং বিদ্যুৎ ব্যবহারের তথ্য জানতে পারবেন। এর জন্য অ্যাপও রয়েছে। তবে গ্রাহকদের নানা অভিযোগ দিয়েও সচেতনতা তৈরি না করার অভিযোগ স্বীকার করেছেন শীর্ষ কর্মকর্তারা।
ডেসকোর ৭ লাখের বেশি প্রিপেইড মিটার গ্রাহক রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান প্রকৌশলী (আইসিটি) মফিজুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, অন্যায়ভাবে গ্রাহকের কাছ থেকে এক টাকাও কর্তনের সুযোগ নেই। সবকিছুই স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিপিডিসির একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সময়কে বলেন, যারা বলেছেন, ফিলিংয়ের পর বেশি টাকা কেটে নেওয়া হয়, কিছু গ্রাহক একই সঙ্গে ৫ হাজার টাকার ভেন্ডিং (রিচার্জ) করেছেন। আসলে মাসে দুই হাজার টাকা খরচ করেন। তাকে 2-3 মাস ভেন্ডিং করতে হবে না। তিনি তৃতীয় মাসে রিচার্জ করলে একসঙ্গে অনেক টাকা কেটে যাবে। কারণ, প্রতি মাসে রিচার্জ না করেই তার লাইন ভাড়া, ডিমান্ড চার্জ ও ভ্যাট-ট্যাক্স জমা হয়। পরে, শুধুমাত্র রিচার্জ করার পরে, এই পরিমাণ একবারে কাটা হয়। বিদ্যুৎ ব্যবহার না করলেও প্রতিমাসে টাকা দিতে হয়। বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে অতিরিক্ত কর্তনের সুযোগ নেই।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফওজুল কবির খান সময়কে বলেন, প্রিপেইড মিটারে কোনো সমস্যা আছে কি না তা আমরা খতিয়ে দেখছি। এজন্য বিশেষজ্ঞদের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এনার্জি অ্যাডভাইজার অধ্যাপক এম শামসুল আলম টাইমসকে বলেন, যেহেতু ভোক্তারা অভিযোগ করছেন, তাই তা আমলে নিতে হবে। তাদের অ্যালগরিদম এবং সফ্টওয়্যার সঠিক কিনা তা দেখতে BERC একটি নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে মিটার পরীক্ষা করা উচিত। যাচাই-বাছাই শেষে গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সমাধান প্রকাশ করতে হবে।
এই শক্তি বিশেষজ্ঞ বলেছেন যে তাদের মধ্যে গলদ এবং বাম্প রয়েছে। কারণ তারা নিজেরাই দাম নির্ধারণ করে। এ বিষয়ে আমরা বিইআরসিতে অভিযোগ করেছিলাম, ডিপিডিসি এ বিষয়ে কোনো সন্তোষজনক জবাব দেয়নি। বিইআরসি তা করতে বলা সত্ত্বেও তাদের বিচার করেনি। এখানে বিইআরসির দোষ, তারা নিষ্ক্রিয়তা দেখিয়েছে।
শামসুল আলম বলেন, সব কোম্পানির চেয়ারম্যান হচ্ছেন বিদ্যুৎ সচিব। কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্যুৎ সচিবের অভিযোগ তারা আমলে নেয় না। মনে হচ্ছে অভিযোগটি বিদ্যুৎ সচিবের বিরুদ্ধে। এ ধরনের মনস্তাত্ত্বিক সংকীর্ণতা ভোক্তাদের দুর্ভোগ বাড়াচ্ছে। তিনি বলেন, বিইআরসিকে ভোক্তাদের সুরক্ষার জন্য নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে কাজ করা উচিত, কিন্তু তারা তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিইআরসি এখন নতুন পরিস্থিতিতে পুনর্গঠন করা হচ্ছে। আমরা আশা করি বিইআরসি এখন তাদের আইনি প্রক্রিয়ায় এগুলো বিবেচনা করবে।